গ্রামের পশ্চিম পার্শ্বে পরিত্যক্ত বিশাল আম বাগানের উত্তর দিকে কিছুদুর হেঁটে গেলে গ্রাম থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন, নির্জনে যে একজোড়া ছনের ছাওয়া বেড়ার ঘর আছে, তারি একটি থেকে এই সকাল বেলা ভেসে এল ভাঙা ভাঙা, অসুখ পীড়িত কর্কশ অথচ উদিগ্ন শব্দ-ওরে ছলেমা, শমসেদের লাহারী খাওয়া হলো, কামে যাবে না?” ছলেমা টিনের গলাওয়ালা থালিতে রাতের পানি দিয়ে রাখা ভাতের উপর একটা ছিলা পেঁয়াজ ও গোটা দুই পোড়া মরিচ নিয়ে ঘরের বারান্দায় ল্যাটা মেরে বসে থাকা সাস্থ্যবান শমসেদের সামনে রেখে দিয়ে কিছু না বলেই আলতো মুচকি হেসে পেছন ফিরে যেতে যেতেই প্রতি উত্তরে উচ্চেই বলল-এহুন দিনু, খায়ি-দায়ি যাবে।”
শমসেদ তখনও হাত লাগায়নি থালে বরং পেছন ফিরে চলে যেতে থাকা ছলেমার ভারী সুগঠিত নিতম্বের দিকে চেয়ে আছে একভাবে লোলুপের মত! বারান্দার উপর থেকে থালা রেখে নামার সময় যখন ছলেমার নিতম্ব দুলে উঠল, তখন যেন ওর বুকের ভেতরে কোথাও একদলা রক্ত ছলকে উঠল প্রচন্ডভাবে! ও দেখল ছলেমার কাপড় ভাঁজ হয়ে ঢুকে আছে নিতম্বের ভাঁজে। ওর ভীষণ কষ্ট হতে লাগল! ও এত সুন্দর সুগঠিত নিতম্ব আর কারোরি দেখেনি, যেন সমসত শরীরের উদারতা নিতম্বেই এসে জমা হয়েছে সর্বোতভাবে, সেই সাথে অবর্ণনীয় সুন্দরতা। ও যখনি দেখে তখনি একরাশ অজানা কষ্ট অনুভব করে নিজের ভেতরে। আজকাল যেন সেই কষ্টটা আরও বেশি করে অনুভূত হয় আর দেখামাত্র নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা কোনভাবেই।
মাথাটা কেমন জানি ঝিম ঝিম করে উঠে! এক ধরনের হিংস্র ক্রোধ ভাব রক্তের কণায় কণায় টের পায়, ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলেতে ইচ্ছে হয় ঐ ভয়ানক যৌবনময় শরীরটাকে দাঁত দিয়ে! তখন সে যেন আর রক্ত মাংসের মানুষ থাকেনা, হয়ে যায় রক্ত খাওয়া হিংস্র বাঘ, যার কাছে সব কিছুই তুচ্ছ হয়ে প্রধান হয়ে উঠে উষ্ণ মাংসের নেশা। কোন কিছুতেই নিজেকে শানত করতে পারেনা, কেবল সেই নারী শরীরে প্রকট হয় থাকা যৌবনের লোলুপতায় নিজের ভেতরে প্রচন্ডভাবে অনুভব করে অদমিত এক অন্য ক্ষুধার, যা নিবৃত্ত না হলে সে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে, নতুবা মারা যাবে। ছলেমা পানতা ভাতের থালা রেখে চলে গেছে অনেক্ষণ! ও তখনও বসে বসে আছে ওভাবেই! ঘরের ভেতর থেকে আবারও ভেসে এল সেই একি স্বর, ও ছলেমা, শমসেদের খাওয়া হয়ি গেছ ? ও গেল? হেঁসেল ঘর থেকে উত্তর দিতে যাবার আগে ছলেমা একবার মুখ বের করে দেখল বারান্দায়। কিছুটা যেন সে চমকে উঠল ভাতের থালা নিয়ে বারান্দাতেই শমসেদের ক্রোধান্বিত ভঙ্গিমাতে নির্জীব বসে থাকাতে। একটা উত্তর দেবে যেই ভাবছে, অমনি শমসেদের চোখে চোখ পড়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে শমসেদ অপলক তাকিয়ে থেকে কি যেন মনে করে ভাতের থালি ওভাবেই ফেলে রেখে নিজেই উঠে গেল সোজা সে ঘরের দিকে, যেখান ভেসে আসছিল শব্দ। ছলেমা কান করে শুনল, ও ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বলছে, ”ভাই আজকি কামে যাবোনা, শরীলডা কেমুন য্যান করছে। আমি ওসমান চাচাক বুলি আসিগ্যা আইজ কাম করতে পারবনা, কাল করি দিবোন!” কথাগুলো শেষ হবার পরে পর-ই উৎকণ্ঠা মেশানো স্বরের উচ্চারণ,”ক্যানরে, কি হলো? অসুখ-টসুখ করে নিতো আবার ? না হলে ফরিদের ডিসপেনসারিত থাকি ক’টেকার ওষুধ কিনে আনি খা। অসুখ হলি কাম করবি কি করি, বারষার সুম তো আলো বুলি, এহুন কাম না করলে তহুন খাব কি ?
কথাগুলো যেন শমসেদের মাথার ভেতরে আগুন ধরিয়ে দিল ধা ধা করে! এবার যেন ওর ভেতরের সেই হিংস্রতা বেরিয়ে পড়ল প্রকটরুপে! কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় দেখে ছলেমা হেঁসেল ঘর থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে ওর থেকে কিছু দুরে চালের খুঁটি ধরে। ও ঘুরে তাকাতেই চোখ পড়ল ছলেমার ব্লাউজ বিহীন সুতীর শাড়ী ভেদ করে বেরিয়ে পড়া উদ্ধত এক জোড়া বুকের দিকে! সকালের গোসল সেরে আর্দ্র শাড়ী বুকের সাথে সেটে থাকায় আকারগুলো আর বেশি সুস্পষ্ট ও সুতীব্র হয়ে আছে, যা ওর কাছে সীমাহীন উত্তেজনায় প্রায় অসহ্য ঠেকলো! রাগ আর ক্রোধে ছলেমার মুখের উপরি কিছুটা নীচু স্বরেই বলে বসল, শালার তাবদ কাম আমাখি করতে হবে? আমি একটা বলদ নাকি?” ওর উচ্চারিত শব্দগুলো ঘরের ভেতরে পৌঁছাল কিনা বোঝা না গেলেও ছলেমা যে প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে, তা বুঝতে ওর বাকি থাকলনা। ওর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ নিচু হলেও, তাতে ঝরে পড়ছিল সীমাহীন ক্রোধ আর একটা অসহ্য উন্মাদনা! ও কথাগুলো বলতে বলতেই রেবিয়ে গেল বাড়ি থেকে! মনের ভেতরে একসাথে অজস্র ক্রোধের ঝংকার সইতে সইতে নিজে নিজেই বিড়বিড় করতে থাকল, বাড়ি থেকে শদেড়েক কদম দুরে আমের বাগানের দিকে যেতে যেতে আর আপনা আপনিই তখনও বলতে থাকল, ”শালার বরষার সুম খাব কি, আমি তার কি জানি? আমি কি বাড়ির খাটি খাওয়ানি বলদ, যে একলাই কাম করি খাওয়াবো তাবোদেক আর শালা তুমি বসি বসি গিলব্যা! সারাডা বছর বসি বসি গিলা, রাতে বউ লিয়ে ফূর্তি আর এদিক আমি একলাই কাম করি করি মরি! তুমার পা পঁচে গেছ তো আমি কি করবো? শালা মরিও যায় ন্যা! মরলে বেবাক আপদ চুকি যাতক। আর ভাললাগেনা!”
প্রচন্ড ক্রোধে মানুষ কখনও কখনও চরম অবসাদ ও ক্লানিত অনুভব করে দেহ মন সবখানেই। তখন কোন কিছু সহ্য করে নিজেকে সংযত বা স্বাভাবিক রেখে সুস্থির চিনতা-ভাবনা করা যায়না। অবসাদ আর ক্লানিততে নিসেতজ করে দেয় সবটুকু প্রাণ শক্তি। শমসেদের সেই অবস্থা হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লানিত ও অবসাদে ভারক্রানত হয়ে একটা ফজলি আম গাছের নীচে শুকনো মত জায়গা দেখে কোমরের গামছাটা খুলে বিছিয়ে শুয়ে পড়ল কপালের উপর বাম হাতটা তুলে। সকালের অভুক্ত পেটে ক্ষুধাগুলো বেশ করে দৌড়াতে থাকলেও, ওর যেন ক্ষুধা বোধ হচ্ছিলনা সেভাবে। শুয়ে থাকতে থাকতেই কেবলি মনে পড়ে যাচ্ছিল ছলেমার ভারী নিতম্ব, বারান্দা থেকে নামার সময় ছলকে উঠা কোমল মাংসের দোলুনী আর ভেজা বুকে সেটে থাকা কাপড় ভেদ করে বেরিয়ে পড়া সুগোল বুকের সুতীব্র উদ্ধত্য! ক্ষুধাগুলো হারিয়ে গিয়ে মনের ভেতরে জেগে উঠল অন্য এক ক্ষুধা, যাকে প্রশমনের উপায় না পেয়ে নিজেই নিজেই মাথা উপুড় হয়ে মাটির সাথে ঠুকতে লাগল অবিরাম! ছলেমা কখন এসে পাশে বসেছে বলতে পারবেনা ও! খোলা পিঠের উপর আলতো একটা হাত পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠে দেখে একদম সামনে বসে আছে ছলেমা। সকালের এই নির্জনতায় আশেপাশে কেউ নেই, কেবলমাত্র দুটি প্রাণী এই বাগানে।
গ্রাম বিচ্ছিন্ন এই খাঁ খাঁ নির্জনতায় ছলেমাকে নিজের সামনে ওভাবে পেয়ে ও নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলোনা। ছলেমা ওর চোখে চোখ রেখে বলছে- ”তুমি খায়ি আল্যানা কেন ? কি হয়িছ তুমার ? তুমি কেমুন য্যান হয়ি যাছো! কি হয়িছ তুমার বুলোধিন?” বলেই হাতটা ওর কাঁধের উপর রাখতেই শমসেদ কোন উত্তর না দিয়েই মুহূর্তেই দুহাতে নিজের শরীরের সাথে আপ্রাণ জড়িয়ে ধরে বলতে থাকল- ”না, আমি আর পারছিন্যা! আমি তুমাক ছাড়া বাঁচপনা, আমি মরি যাব! আমি তুমাক ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছিন্যা, আমাক তুমি বাঁচাও! আমাক বাঁচাও! আমি মরি যাব...” বলতে বলতে ছলেমাকে জড়িয়ে ধরেই শিশুর মত কাঁদতে থাকল! ছলেমা তাজ্জব হয়নি এতটুকু, কারণ ও আগে থেকেই আন্দাজ করে নিয়েছিল ব্যাপারটা। ছয় বছর থেকে দেখছে সে শমসেদকে, কিন্তু এই শমসেদ তো সেই শমসেদ নয়, যাকে বিয়ের পর থেকে দেখে আসছে কিংবা বিয়ে হয়ে এসেও দেখেছিল। ওর স্বামী জমসেদের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে ছবছর। জমসেদ সব কিছুই বলেছিল ছলেমাকে আর এও বলেছিল- আমার এই বাপ-মা মরা ভাইডাক তুমি এটটু দেহো, অক আমি খুব আদর করি মানুষ করিছি, কহুনও কষ্ট দিইনি এতটুক, তুমি অক দেহো।” জমসেদের কাছ থেকেই ও শুনেছিল কি করে মানুষ করেছে শমসেদকে। ওকে আট বছর বয়স রেখেই মারা যায় শ্বাশুড়ি। শ্বশুর মারা গিয়েছিল আরও আগেই। সেই বয়স থেকে ওর স্বামী নিজেই মায়ের মত আদর দিয়ে ওকে মানুষ করেছে। সে সব দিনে দু’ভায়ের একে অপরের প্রতি ভালবাসা ছিল দেখার মত। ছলেমা নিজেও বিয়ে হয়ে আসার পর দেখেছে শমসেদের অফুরনত ভালবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ বড় ভাইয়ের প্রতি। কোনদিন দেখেনি এতটুকু জোরে কথা বলতে বা মুখের উপর উত্তর করতে, আর সেই শমসেদ আজ ...! একদিকে যেমন ছলেমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল, অপরদিকে শিশুর মত করে শমসেদকে কাঁদতে দেখে প্রচন্ড মায়াও হচ্চিল ভেতরে ভেতরে। দীর্ঘ ছ’বছর ধরে দেখে আসা এই পুরুষটাকে কখনওতো কাঁদতে দেখেনি। চোখের সামনেই না সে ধীরে ধীরে বড় হল, হল যৌবন প্রাপ্ত আর আজ ওকে জড়িয়ে ধরে এত আকুল হয়ে কাঁদছে দেখে নিজের অজান্তেই ছলেমার ভেতরটা ডুকরে উঠল!
হয়ত কিছু কিছু নিয়তি এমনি হয় কিংবা মানুষের আপেক্ষিক পরিবর্তন সেইভাবেই ঘটে, যখন সার্বিক পরিস্থিতি থাকে অভিযোজন বা পরিবর্তিত হতে বাধ্য হবার চুড়ান্ত অনুকুলে। নতুবা বিয়ের তিন বছরের মাথায় পায়ের ভেতরে খেজুরের কাটা ঢুকে কেন তার স্বামীর একটা পায়ে পচন ধরবে যা বন্ধ করার জন্য কেটে ফেলতে হয়? তাতেও শেষ না হয়ে পচন আরেক পায়ে সংক্রমিত হয়ে সেটাও কেটে কেন একতাল জড়ভরত মাংসের ন্যায় বিছানায় পড়ে থাকবে ঐ শক্তিশালী মানুষটা বছরের পর বছর? সে সময় শমসেদ না থাকলে সংসারের হাল কি হত ছলেমা জানেনা, ভাবতেও পারেনা। শসসেদ নিজেও সংসারের হাল নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল খুশি মনেই। তখন ওর মনে ছিল পবিত্র দায়িত্ববোধ আর বড় ভাইয়ের প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধা অথচ সেই শমসেদ কি করে এভাবে বদলে গেল? যদিও দু’জনের বয়সের পার্থক্য কত ছলেমা ঠিকভাবে জানেনা, তবে ওর নিজেকে ওর থেকে দু’এক বছরের বড়ই মনে হয়। আজ শমসেদ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ও আর পারছেনা, ওকে ছাড়া বাঁচবেনা! ছলেমার নিজের কাছেই নিজের বোধগুলো শুন্য মনে হচ্ছিল! নিজেকে ও শমসেদের শরীরে জড়িয়ে রাখা অবস্থাতেই বলল- ”ছাড়ো! কেউ দেহি ফেললে কেলেংকারী হয়ি যাবে। তুমি এমুন করোনা, আমি তুমার বড় ভাইয়ের বোউ, তুমার ভাবী, তুমি এমুন কি করি ভাবতে পারল্যা? তুমি তো এমুন ছিল্যানা! মাথাডা ঠান্ডা করো, পাগলামো করোনা, ভাল করি ভাবি দেহো, এডি পাপ? তাছাড়া তুমার বড় ভাই, এহুনও বাঁচি আছ! কত কষ্ট করি তুমাক বাপ-মায়ের আদর দিয়ি মানুষ করিছ আর আজ তুমি যদি এমুন কর তাহিলে মানষ্যেই বা কি বুলবে ? তুমিই বা সবার সামনে মুখ দেহাবে কেমুন করি আর আমি কিংবা তুমার ভাই? চলো, বাড়িত চলো, খায়ি-দায়ি কামে যাবা। মুন থাকি সব পাপ ফেলি দেও, চলো!” শমসেদের ক্রোধ সীমা ছাড়িয়ে যায়! ঝটিতে ছলেমাকে ছেড়ে দিয়ে বলে- ”আমাক কি তুমরা বেবাগ কলুর বলদ পায়িছো, যে তুমারেক কামায় করি করি খাওয়াবো সারাডা জীবন! আমার কুনো সাদ-আল্লাদ নাই? তুমরা তুমারির কথাডাই ভাবছো আর আমি..? বড় ভাই আছ তো কি হয়িছ আর ওই কি পারে তুমার সাথ? তুমি খালি খালি কেন ওর সাথ থাকপা? আমিতো মাঝি মধ্যেই শুনি তুমি অক বুলছো, গায়ে হাত দিয়োনা, সরি থাকো! কাল রাতেও তো তুমি বুলছিল্যা, না, জ্বালায়োনা! কেন খালি খালি চেষ্টা কর, পারনা আর আমার কষ্ট হয়, ঘুমাত পারিনা সারারাত। ছাড়ো, সর-ই ঘুমাও।” কথাগুলো শেষ হবার সাথে সাথেই যেন ছলেমার সত্বায় বাজ পড়ল! গভীর করে তাকিয়ে দেখে শমসেদের চোখে! সেখানে তাকিয়ে আরেকবার আঁতকে উঠে ভেতরে ভেতরে! ওর সমস্ত মুখে ফুটে উঠেছে ক্রোধান্বিত অভিব্যক্তি, যেখানে যুগপৎ মিশে আছে নিজের পৌরষিত গৌরবের তীর্যক চাহনী আর ভাইয়ের অক্ষমতার জন্য চরম ঘৃণা। ছলেমা যেন কুঁকড়ে গেল ভেতরে ভেতরে! আসলে দু’টো ঘর পাশাপাশি থাকলে, আর তা যদি হয় বেড়ার, তবে যে আরও সাবধান হতে হয় সেটা খেয়ালই ছিলনা। তাছাড়া ওকে নিয়ে সেরকম ভাবনা হয়ত ওর মনে আসেনি। যদিও একটা ক্ষুদ্র ঘটনা একবার মনে কিছুটা খটকার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল কিন্তু সেটাও পরে ভুলে গিয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল মাস ছয়েক আগে, যেটা আজ মনে পড়ে গেল।
সেদিন প্রচন্ড গরম পড়ায় দুপুর বেলা আরেকবার গোসল করে কাপড় ছাড়ছিল দরজা ভিড়িয়ে রেখে। হঠাৎ কি যেন মনে হওয়াতে বাইরে এসে দেখে দক্ষিণ পাশে বেড়ার কাছে চোখ মুখে চরম উত্তেজনা আর ঘামে জবজবে হয়ে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে শমসেদ। যদিও সে কামে গেলে দুপুরে খেতে আসেনা কারণ যার কামে যায় সেখানেই দুপুরে খেতে দেয়। তবে যেদিন যেদিন আধখোরাকির কাম থাকে সেদিন দুপুরে বাড়িতে খেতে আসে। শমসেদকে তখন ওভাবে দেখে কিছু একটা গভীর ভাবে ভাববার আগেই মনে হয়েছিল, ছেলেটা কাম থেকে এসেছে, নিশ্চয় খুব ক্ষুধা লেগেছে, তাই জলদি খেতে দিয়েছিল। ঘটনাটা আজ মনে পড়ে গেল। শমসেদ তাহলে ওকে অনেক আগে থেকেই নিজের মনের ভেতরে জায়গা করে দিয়ে রেখেছে। ছলেমা নিজে ভেবে কিছু বের করতে পারছিল না, কেবল বার বার করে ওর নিজের শরীরটাকেই মনে পড়তে লাগল! ও নিজেও তাজ্জব হয়ে যায় নিজের শরীরের এই রুপ দেখে! ভেবে কুল পায়না, এই অভাবী সংসারে শরীরের এই বাড়-বাড়নিত ভাব কি করে আসে ? তাছাড়া প্রতিরাতেই ওর স্বামী না পারলেও জোর করে বাধ্য করে মিলনে, যেখানে পা দুটো কেটে ফেলার পর থেকেই ওর যৌনশক্তি ক্ষয়ে গেছে অথচ সেই ক্ষয়িষ্ণু যত কিঞ্চিত বেঁচে থাকা যৌনক্ষুধাতেও প্রায় প্রতি রাতেই ওর শরীরে গমন করে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিসেতজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে পাশে। ছলেমার গত তিনটি বছর এভাবেই কেটেছে, রাতের পর রাত অতৃপ্তিত শরীরের জ্বালায় জেগে থেকেছে দুটো পা হীন, মাথা থেকে কোমর সর্বস্ব একতাল জড়ভরত মাংসের পাশে, যে ঘুমিয়ে থাকে সুখোকর ক্লানিতর প্রশানিততে! ছলেমা মাঝে মাঝে ভাবত আমার অতৃপ্তিত শারীরীক ক্ষুধায় কি আমার শরীরকে এভাবে ভর-ভরনত করে তুলছে ? কোথাও যেন কোন কমতি নেই যৌবনের !
আজকাল ছলেমার আর সহ্য হয়না প্রতিরাতের সেই অসহ্য যন্ত্রণা, যা রাতভর জেগে থেকে ওকে একা একা ভোগ করতে হয়। প্রথম দিকে তাও কিছু হলেও যৌনশক্তি অবশিষ্ট ছিল ওর স্বামীর, কিন্তু এখন সেটুকুও নেই, অথচ প্রতিরাতেই সেই আগের মতই অবস্থা, জোর করে মিলনে বাধ্য করে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে ছেড়ে দেয়া রাতভর। ছলেমা আর সহ্য করতে না পেরে গত কয়েকমাস ধরে আর সায় দেয়না আগের মত। ওর স্বামী জোর করলে ওই ঠেলে দুরে সরিয়ে দেয়, মাঝে মাঝে বিরক্তিতে শব্দ করে উঠে, যা কাল রাতেও করেছিল। নিশ্চয় শমসেদ এসব শুনেছে গত কয়েকমাস ধরে আর যা কখনও ভাবতে পারেনি তাও হয়ত ওর মনে বাসা বেঁধেছে। মানুষের গোপন প্রবৃত্তি গুলো খুব কাছ থেকে যখন জেগে ওঠার প্রত্যক্ষ উসকানি পায় তখন তাকে রোধ করা মানুষের সাধ্যর বাইরে চলে যায়। ছলেমা কিছুই বলতে পারলনা! শমসেদের পাশ থেকে উঠে চলে গেল বাড়ির দিকে। শমসেদ রাগে, ক্ষোভে একভাবে তাকিয়ে থাকল ছলেমার চলে যাবার দিকে আর কিছু একটা সংকল্প করে বসল মনের ভেতরে।
এরপর মাস তিনেক হয়ে গেছে কিন্তু এর মধ্যে শমসেদ কখনও ভুলেও আর তাকায়নি ছলেমার দিকে কিংবা কথা বলার চেষ্টা করেনি এতটুকু। ছলেমা নিজে বার বার আগ বাড়িয়ে কথা বলেছে, খেতে ডেকেছে, বাড়িয়ে দিয়েছে ভাতের থালি আর শমসেদ প্রতিবার-ই মাথা নিচু করে খেয়ে উঠে গেছে, একবারও চোখ তুলে তাকায়নি ওর দিকে। ছলেমার বুকে বিঁধেছে বার বার করে ওর এড়িয়ে যাওয়াটা। একটা গভীর অপমান বোধে ভেতরে ভেতরে সেও হয়ে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে ক্রোধান্বিত ওর প্রতি। যখন মানুষ স্বাভাবিক বিশ্বাসবোধে আকস্মিক বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন তার প্রবৃত্তিগুলো হয় সেভাবেই উজ্জীবিত, তা সে অনুরুপ পথে হোক কিংবা বিপরীত পথে। ছলেমারও হয়েছিল। মাঝে মাঝে ওর মনে হয়েছে, কি করে পারে শমসেদ তাকে এভাবে তুচ্ছ ভাবতে, এড়িয়ে যেতে ? যেখানে আজকাল গ্রামের যুবা থেকে বৃদ্ধ প্রায় সবাই ওর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, সামান্যতম কথা বলার জন্য থাকিয়ে মুখিয়ে, কেউ কেউ করে বসে খারাপ ইঙ্গিত মুখের উপরেই, সেখানে ও কি করে পারে এত সময় এক বাড়িতে এত কাছাকাছি থাকার পরও ওকে এভাবে এড়িয়ে যেতে? এমনকি একটিবার চোখ তুলে তাকায়ওনা ভুলে, অথচ এ সেই শমসেদ যে নিজেই সেদিন বাগানে ওকে শরীরে প্রচন্ডভাবে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমাক বাঁচাও, আমি পারছিনা আর, আমি তুমাক ছাড়া বাঁচপনা! আমাক বাঁচাও, না হলে মরি যাবো; তাহলে? ছলেমার ক্রোধ ও জিদ যেন ওকে গ্রাস করে নিচ্ছিল দিনকে দিন আর ও হয়ে উঠছিল অন্যরুপী ভেতরে ভেতরে ।
এর কয়েকদিন পরে এক সকালে হঠাৎ করে জমসেদের বুকে ভয়ানক ব্যাথা শুরু হয়। শমসেদ কামে গিয়ে খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে দেখে বাড়ি ভর্তি লোক জমে গেছে! ছলেমা ওর স্বামীকে নিয়ে কান্নাকাটি করছে! ব্যাথায় কোঁকাতে থাকা প্রায় নীল হয়ে আসা নিজের বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শমসেদ অনেকদিন পরে সার্বিক অর্থেই ভুলে গেল তার সব ক্রোধ, কামনা-বাসনা, বিপরীত মনোভাব। মুহূর্তেই নিজের সব দায়িত্ববোধ ফিরে পেয়ে মনের মধ্যে অনুভব করল একরাশ জমাট বাধা ব্যাথা ও সুতীব্র অনুশোচনা! ওর মন পড়ে গেল ওর শৈশবের সেই দিনগুলি, যখন তার ভাই তাকে দিনের পর দিন কষ্ট করে মানুষ করেছে। কোন আবদার অপূরণ রাখেনি কখনও। যখন যা চেয়েছে, তখন তাই দিয়েছে। মা-বাবা দু’জনার আদরেই তাকে বড় করে তুলেছে আর সে ভাই আজ চরম ব্যাথায় কাতরাচ্ছে অথচ ও কিছুই করতে পারছেনা। হঠাৎ কি মনে হতেই, শমসেদ ছুটে গিয়েছিল ভাইকে নিয়ে শহরের হাসপাতালে। দুটো দিন শহরের হাসপাতালে দৌড়াদুড়ি করতে করতে ভুলে গিয়েছিল নিজেকেসহ সবকিছু। দুদিন পরে কিছুটা আরাম হওয়াতে ডাক্তার বলেছিল- ”আরও দুটোদিন থাকলে বলতে পারব রোগীর অবস্থা, এখনও বলা যাচ্ছেনা কিছুই। তবে বেশ কিছু দামী ঔষধ লাগবে, আপনি কাল আমার সাথে একবার যোগাযোগ করুন।”
দুদিন আগে যখন ভাইকে নিয়ে ও শহরে আসে তখন নিজের কাছে যা টাকা ছিল তাই নিয়ে এসেছিল। এই দুদিনে দৌড়া-দুড়ি আর যাবতীয় ঔধষ-পত্র কিনতে কিনতে সব খরচ হয়ে গেছে। এখন আরও টাকা লাগলে তার গ্রামে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। প্রায় তিনমাস পরে সে ছলেমার কাছে গিয়ে বলল- ”ভাইয়ের ওষুধ কিনার লাগি আরও টেকা লাগবে, আমার কাছ তো আর টেকা নাই। আমি গ্রামে যাই, কাল সকালে টেকা লিয়ে আবার চলি আসপো।” ছলেমা সরাসরি তাকিয়েছিল ওর চোখের দিকে, যেনবা ঘৃণা, কিংবা অজানা ক্রোধ আর সেই সাথে ভর্ৎসনা। কেবল উত্তরে বলেছিল- ”এহানে আমাক রাখি যাছো, আমি কার কাছ থাকপো? আমি কি কুনোদিন এমুন করি থাকিছি?” ও তাকিয়েছিল ছলেমার মুখের দিকে নির্বাক অপরাধীর মত! শেষে ছোট করে বলেছিল,”তাইলে আমি করব?” ছলেমা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলেছিল- ”তুমিতো কাল সকালে আসপা, আমাক-ও লিয়ে চলো তুমার সাথ। বাড়ি-ঘরের কি অবস্থা জানিন্যা, পাড়াপাড়িতে কুনো কিছু ঠিক না করিই চলি আসিছি। তুমার সাথ গেলে সব ঠিক-ঠাক করি তুমার সাথ আমিও আবার সকালে চলি আসপো।” ও তাকিয়েছিল ছলেমার দিকে অথচ ছলেমার মুখ ছিল অন্য দিকে ফেরানো।
শেষে দুজনাই এসেছিল গ্রামে। ফেরার সময় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল আর আকাশটাও ছিল থম্*থমে হয়ে, যেনবা ঝড় তুলবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে। দুজনে পাশাপশি হাঁটতে হাঁটতে শমসেদএকবার খালি আসেত করে বলেছিল- ”ঘরডা এবির আর ছাওয়া যাবেন্যা, টেকা তো সব শেষ, ঝড়-টড় উঠলে না জান কি হয়?” ছলেমা উত্তর করেনি। রাতে খাওয়ার পর শুতে যাবে এমন সমসত দুনিয়া কাঁপিয়ে বেশ জোরে শুরু হল বাতাস, যা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের রুপ নিল! শমসেদ ভীষণ ভয় পেয়ে ভাবল, ঘর বাড়ি যেন সব উড়ে যাবে এখুনি! ও একবার ছলেমার কথা ভেবে বাইরে এসে দেখল, ছলেমা নির্বীকার ভাবে বসে আছে ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে, যেন ওর কোন হুশ নেই। ওর নিজের ভেতরেই চলছে কোন এক মহা প্রলংকারী ঝড়। শমসেদ কিছু বুঝতে পারলোনা, ক্রমশ একট অজানা আশংকায় ছলেমার কাছে যাবার আগেই ঝড়ের প্রকোপ আরও বেশি হল।
ও ছুটে বাইরে এসে ঘরের চারপাশ ঘুরে ঘুরে চাল-টাল ঠিক আছে কিনা দেখতে লাগল। দু’এক জাগায় নড়বড়ে দেখে তার দিয়ে শক্ত করে বেধে দিল। এরি মাঝে শুরু হয়ে গেল ঝম্*ঝমে বৃষ্টি। ও সবকিছু ঠিক ঠাক করে ভেজা শরীরে ঘরের মধ্যে এসে দেখে ছলেমা দাঁড়িয়ে! ওদিকে হাসপাতালে ওর বড় ভাইয়ের বুকের ব্যাথাটা আবারও হঠাৎ করে বেড়ে যায়। ঝড়ের রাতে বেডে পড়ে থেকে থেকে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ডাকছিল- ”ছলেমা! ছলেমা! শসসেদ! আমি পারছিনা, আমাক বাঁচা!” এই দুর্যোগময় রাতে ঝড় আর বৃষ্টির তান্ডবতা ভেদ করে সেই আর্তি কারও কাছে পৌঁছাচ্ছিল না! এদিকে ঘরে ঢুকতেই ছলেমা দৌড়ে এসে প্রচন্ডভাবে আঁকড়ে ধরল ওকে। ও বুঝতে পারার আগেই ছলেমা দু’হাতে প্রাণপণ আঁকড়ে ধরে ওর বুকের ভেতরে মুখ ঘষতে লাগল অনবরত! ওর মাথায় ঢুকছিলনা ও কি করবে ? কেমন জানি নিজেকে বোধ শূন্য পাচ্ছিল! নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু করার আগেই ঘরের ভেতের কাঁপতে থাকা বাতির হালকা আলোতে দেখল, ছলেমা এক এক করে সব কাপড় খুলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে নগ্ন! ঝড়ের প্রচন্ড তান্ডব আর প্রবল বৃষ্টিতে ওর মনে হচ্ছিল সব কিছু যেন ভেঙে-চুরে, ধুয়ে-মুছে নিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে। সব কিছু বিনাশ হযে যাবে, কেবল ও আর ছলেমা থাকবে তখনও এইভাবে, এই ঘরে। ও আসেত আসেত এগিয়ে গেল ছলেমার দিকে, ছলেমা গভীর আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে নিজেকে এলিয়ে দিল ওর শরীরে। প্রচন্ডভাবে কাঁপতে থাকা ছলেমাকে নিয়ে ও চলে গেল বিছানায়।
শমসেদ বিছানায় যখন ছলেমার শরীরে উপগত, তখন হাসপাতালের বেডে সীমাহীন যন্ত্রণায় সমস্ত ঝড়-বৃষ্টিকে বিদীর্ণ করে একটা চিৎকার একটানা ভেসে বেড়াচ্ছিল- ছলেমা! ছলেমা! শমসেদ! আর পারছিন্যা, আমাক বাঁচা! আর তখন ছলেমা ঘর্মাক্ত শমসেদের শরীরের নিচে রক্তের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্য ক্ষুধায় ভয়ানক ক্ষুধিত হয়ে ওর পিঠের বিভিন্ন অংশে নোখ বসিয়ে আমূল টানছিল আরও গভীরে, আরও ভেতরে! বাহ্যিক বোধহীন দুজনাই উন্মত্ত হয়ে ডুবেছিল সেই ভয়াল ক্ষুধায়! বেশ কিছুক্ষণ পর শমসেদ যখন ক্লানিততে এলিয়ে পড়ল ছলেমার পাশে, তখন হাসপাতালের বেডে একটা সাদা পোশাক পরিহিত হাত, আরেকটি নিথর ঠান্ডা হাত আলতো করে বিছানায় রেখে বলল-শেষ!
শমসেদ তখনও হাত লাগায়নি থালে বরং পেছন ফিরে চলে যেতে থাকা ছলেমার ভারী সুগঠিত নিতম্বের দিকে চেয়ে আছে একভাবে লোলুপের মত! বারান্দার উপর থেকে থালা রেখে নামার সময় যখন ছলেমার নিতম্ব দুলে উঠল, তখন যেন ওর বুকের ভেতরে কোথাও একদলা রক্ত ছলকে উঠল প্রচন্ডভাবে! ও দেখল ছলেমার কাপড় ভাঁজ হয়ে ঢুকে আছে নিতম্বের ভাঁজে। ওর ভীষণ কষ্ট হতে লাগল! ও এত সুন্দর সুগঠিত নিতম্ব আর কারোরি দেখেনি, যেন সমসত শরীরের উদারতা নিতম্বেই এসে জমা হয়েছে সর্বোতভাবে, সেই সাথে অবর্ণনীয় সুন্দরতা। ও যখনি দেখে তখনি একরাশ অজানা কষ্ট অনুভব করে নিজের ভেতরে। আজকাল যেন সেই কষ্টটা আরও বেশি করে অনুভূত হয় আর দেখামাত্র নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা কোনভাবেই।
মাথাটা কেমন জানি ঝিম ঝিম করে উঠে! এক ধরনের হিংস্র ক্রোধ ভাব রক্তের কণায় কণায় টের পায়, ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলেতে ইচ্ছে হয় ঐ ভয়ানক যৌবনময় শরীরটাকে দাঁত দিয়ে! তখন সে যেন আর রক্ত মাংসের মানুষ থাকেনা, হয়ে যায় রক্ত খাওয়া হিংস্র বাঘ, যার কাছে সব কিছুই তুচ্ছ হয়ে প্রধান হয়ে উঠে উষ্ণ মাংসের নেশা। কোন কিছুতেই নিজেকে শানত করতে পারেনা, কেবল সেই নারী শরীরে প্রকট হয় থাকা যৌবনের লোলুপতায় নিজের ভেতরে প্রচন্ডভাবে অনুভব করে অদমিত এক অন্য ক্ষুধার, যা নিবৃত্ত না হলে সে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে, নতুবা মারা যাবে। ছলেমা পানতা ভাতের থালা রেখে চলে গেছে অনেক্ষণ! ও তখনও বসে বসে আছে ওভাবেই! ঘরের ভেতর থেকে আবারও ভেসে এল সেই একি স্বর, ও ছলেমা, শমসেদের খাওয়া হয়ি গেছ ? ও গেল? হেঁসেল ঘর থেকে উত্তর দিতে যাবার আগে ছলেমা একবার মুখ বের করে দেখল বারান্দায়। কিছুটা যেন সে চমকে উঠল ভাতের থালা নিয়ে বারান্দাতেই শমসেদের ক্রোধান্বিত ভঙ্গিমাতে নির্জীব বসে থাকাতে। একটা উত্তর দেবে যেই ভাবছে, অমনি শমসেদের চোখে চোখ পড়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে শমসেদ অপলক তাকিয়ে থেকে কি যেন মনে করে ভাতের থালি ওভাবেই ফেলে রেখে নিজেই উঠে গেল সোজা সে ঘরের দিকে, যেখান ভেসে আসছিল শব্দ। ছলেমা কান করে শুনল, ও ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বলছে, ”ভাই আজকি কামে যাবোনা, শরীলডা কেমুন য্যান করছে। আমি ওসমান চাচাক বুলি আসিগ্যা আইজ কাম করতে পারবনা, কাল করি দিবোন!” কথাগুলো শেষ হবার পরে পর-ই উৎকণ্ঠা মেশানো স্বরের উচ্চারণ,”ক্যানরে, কি হলো? অসুখ-টসুখ করে নিতো আবার ? না হলে ফরিদের ডিসপেনসারিত থাকি ক’টেকার ওষুধ কিনে আনি খা। অসুখ হলি কাম করবি কি করি, বারষার সুম তো আলো বুলি, এহুন কাম না করলে তহুন খাব কি ?
কথাগুলো যেন শমসেদের মাথার ভেতরে আগুন ধরিয়ে দিল ধা ধা করে! এবার যেন ওর ভেতরের সেই হিংস্রতা বেরিয়ে পড়ল প্রকটরুপে! কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় দেখে ছলেমা হেঁসেল ঘর থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে ওর থেকে কিছু দুরে চালের খুঁটি ধরে। ও ঘুরে তাকাতেই চোখ পড়ল ছলেমার ব্লাউজ বিহীন সুতীর শাড়ী ভেদ করে বেরিয়ে পড়া উদ্ধত এক জোড়া বুকের দিকে! সকালের গোসল সেরে আর্দ্র শাড়ী বুকের সাথে সেটে থাকায় আকারগুলো আর বেশি সুস্পষ্ট ও সুতীব্র হয়ে আছে, যা ওর কাছে সীমাহীন উত্তেজনায় প্রায় অসহ্য ঠেকলো! রাগ আর ক্রোধে ছলেমার মুখের উপরি কিছুটা নীচু স্বরেই বলে বসল, শালার তাবদ কাম আমাখি করতে হবে? আমি একটা বলদ নাকি?” ওর উচ্চারিত শব্দগুলো ঘরের ভেতরে পৌঁছাল কিনা বোঝা না গেলেও ছলেমা যে প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে, তা বুঝতে ওর বাকি থাকলনা। ওর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ নিচু হলেও, তাতে ঝরে পড়ছিল সীমাহীন ক্রোধ আর একটা অসহ্য উন্মাদনা! ও কথাগুলো বলতে বলতেই রেবিয়ে গেল বাড়ি থেকে! মনের ভেতরে একসাথে অজস্র ক্রোধের ঝংকার সইতে সইতে নিজে নিজেই বিড়বিড় করতে থাকল, বাড়ি থেকে শদেড়েক কদম দুরে আমের বাগানের দিকে যেতে যেতে আর আপনা আপনিই তখনও বলতে থাকল, ”শালার বরষার সুম খাব কি, আমি তার কি জানি? আমি কি বাড়ির খাটি খাওয়ানি বলদ, যে একলাই কাম করি খাওয়াবো তাবোদেক আর শালা তুমি বসি বসি গিলব্যা! সারাডা বছর বসি বসি গিলা, রাতে বউ লিয়ে ফূর্তি আর এদিক আমি একলাই কাম করি করি মরি! তুমার পা পঁচে গেছ তো আমি কি করবো? শালা মরিও যায় ন্যা! মরলে বেবাক আপদ চুকি যাতক। আর ভাললাগেনা!”
প্রচন্ড ক্রোধে মানুষ কখনও কখনও চরম অবসাদ ও ক্লানিত অনুভব করে দেহ মন সবখানেই। তখন কোন কিছু সহ্য করে নিজেকে সংযত বা স্বাভাবিক রেখে সুস্থির চিনতা-ভাবনা করা যায়না। অবসাদ আর ক্লানিততে নিসেতজ করে দেয় সবটুকু প্রাণ শক্তি। শমসেদের সেই অবস্থা হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লানিত ও অবসাদে ভারক্রানত হয়ে একটা ফজলি আম গাছের নীচে শুকনো মত জায়গা দেখে কোমরের গামছাটা খুলে বিছিয়ে শুয়ে পড়ল কপালের উপর বাম হাতটা তুলে। সকালের অভুক্ত পেটে ক্ষুধাগুলো বেশ করে দৌড়াতে থাকলেও, ওর যেন ক্ষুধা বোধ হচ্ছিলনা সেভাবে। শুয়ে থাকতে থাকতেই কেবলি মনে পড়ে যাচ্ছিল ছলেমার ভারী নিতম্ব, বারান্দা থেকে নামার সময় ছলকে উঠা কোমল মাংসের দোলুনী আর ভেজা বুকে সেটে থাকা কাপড় ভেদ করে বেরিয়ে পড়া সুগোল বুকের সুতীব্র উদ্ধত্য! ক্ষুধাগুলো হারিয়ে গিয়ে মনের ভেতরে জেগে উঠল অন্য এক ক্ষুধা, যাকে প্রশমনের উপায় না পেয়ে নিজেই নিজেই মাথা উপুড় হয়ে মাটির সাথে ঠুকতে লাগল অবিরাম! ছলেমা কখন এসে পাশে বসেছে বলতে পারবেনা ও! খোলা পিঠের উপর আলতো একটা হাত পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠে দেখে একদম সামনে বসে আছে ছলেমা। সকালের এই নির্জনতায় আশেপাশে কেউ নেই, কেবলমাত্র দুটি প্রাণী এই বাগানে।
গ্রাম বিচ্ছিন্ন এই খাঁ খাঁ নির্জনতায় ছলেমাকে নিজের সামনে ওভাবে পেয়ে ও নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলোনা। ছলেমা ওর চোখে চোখ রেখে বলছে- ”তুমি খায়ি আল্যানা কেন ? কি হয়িছ তুমার ? তুমি কেমুন য্যান হয়ি যাছো! কি হয়িছ তুমার বুলোধিন?” বলেই হাতটা ওর কাঁধের উপর রাখতেই শমসেদ কোন উত্তর না দিয়েই মুহূর্তেই দুহাতে নিজের শরীরের সাথে আপ্রাণ জড়িয়ে ধরে বলতে থাকল- ”না, আমি আর পারছিন্যা! আমি তুমাক ছাড়া বাঁচপনা, আমি মরি যাব! আমি তুমাক ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছিন্যা, আমাক তুমি বাঁচাও! আমাক বাঁচাও! আমি মরি যাব...” বলতে বলতে ছলেমাকে জড়িয়ে ধরেই শিশুর মত কাঁদতে থাকল! ছলেমা তাজ্জব হয়নি এতটুকু, কারণ ও আগে থেকেই আন্দাজ করে নিয়েছিল ব্যাপারটা। ছয় বছর থেকে দেখছে সে শমসেদকে, কিন্তু এই শমসেদ তো সেই শমসেদ নয়, যাকে বিয়ের পর থেকে দেখে আসছে কিংবা বিয়ে হয়ে এসেও দেখেছিল। ওর স্বামী জমসেদের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে ছবছর। জমসেদ সব কিছুই বলেছিল ছলেমাকে আর এও বলেছিল- আমার এই বাপ-মা মরা ভাইডাক তুমি এটটু দেহো, অক আমি খুব আদর করি মানুষ করিছি, কহুনও কষ্ট দিইনি এতটুক, তুমি অক দেহো।” জমসেদের কাছ থেকেই ও শুনেছিল কি করে মানুষ করেছে শমসেদকে। ওকে আট বছর বয়স রেখেই মারা যায় শ্বাশুড়ি। শ্বশুর মারা গিয়েছিল আরও আগেই। সেই বয়স থেকে ওর স্বামী নিজেই মায়ের মত আদর দিয়ে ওকে মানুষ করেছে। সে সব দিনে দু’ভায়ের একে অপরের প্রতি ভালবাসা ছিল দেখার মত। ছলেমা নিজেও বিয়ে হয়ে আসার পর দেখেছে শমসেদের অফুরনত ভালবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ বড় ভাইয়ের প্রতি। কোনদিন দেখেনি এতটুকু জোরে কথা বলতে বা মুখের উপর উত্তর করতে, আর সেই শমসেদ আজ ...! একদিকে যেমন ছলেমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল, অপরদিকে শিশুর মত করে শমসেদকে কাঁদতে দেখে প্রচন্ড মায়াও হচ্চিল ভেতরে ভেতরে। দীর্ঘ ছ’বছর ধরে দেখে আসা এই পুরুষটাকে কখনওতো কাঁদতে দেখেনি। চোখের সামনেই না সে ধীরে ধীরে বড় হল, হল যৌবন প্রাপ্ত আর আজ ওকে জড়িয়ে ধরে এত আকুল হয়ে কাঁদছে দেখে নিজের অজান্তেই ছলেমার ভেতরটা ডুকরে উঠল!
হয়ত কিছু কিছু নিয়তি এমনি হয় কিংবা মানুষের আপেক্ষিক পরিবর্তন সেইভাবেই ঘটে, যখন সার্বিক পরিস্থিতি থাকে অভিযোজন বা পরিবর্তিত হতে বাধ্য হবার চুড়ান্ত অনুকুলে। নতুবা বিয়ের তিন বছরের মাথায় পায়ের ভেতরে খেজুরের কাটা ঢুকে কেন তার স্বামীর একটা পায়ে পচন ধরবে যা বন্ধ করার জন্য কেটে ফেলতে হয়? তাতেও শেষ না হয়ে পচন আরেক পায়ে সংক্রমিত হয়ে সেটাও কেটে কেন একতাল জড়ভরত মাংসের ন্যায় বিছানায় পড়ে থাকবে ঐ শক্তিশালী মানুষটা বছরের পর বছর? সে সময় শমসেদ না থাকলে সংসারের হাল কি হত ছলেমা জানেনা, ভাবতেও পারেনা। শসসেদ নিজেও সংসারের হাল নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল খুশি মনেই। তখন ওর মনে ছিল পবিত্র দায়িত্ববোধ আর বড় ভাইয়ের প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধা অথচ সেই শমসেদ কি করে এভাবে বদলে গেল? যদিও দু’জনের বয়সের পার্থক্য কত ছলেমা ঠিকভাবে জানেনা, তবে ওর নিজেকে ওর থেকে দু’এক বছরের বড়ই মনে হয়। আজ শমসেদ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ও আর পারছেনা, ওকে ছাড়া বাঁচবেনা! ছলেমার নিজের কাছেই নিজের বোধগুলো শুন্য মনে হচ্ছিল! নিজেকে ও শমসেদের শরীরে জড়িয়ে রাখা অবস্থাতেই বলল- ”ছাড়ো! কেউ দেহি ফেললে কেলেংকারী হয়ি যাবে। তুমি এমুন করোনা, আমি তুমার বড় ভাইয়ের বোউ, তুমার ভাবী, তুমি এমুন কি করি ভাবতে পারল্যা? তুমি তো এমুন ছিল্যানা! মাথাডা ঠান্ডা করো, পাগলামো করোনা, ভাল করি ভাবি দেহো, এডি পাপ? তাছাড়া তুমার বড় ভাই, এহুনও বাঁচি আছ! কত কষ্ট করি তুমাক বাপ-মায়ের আদর দিয়ি মানুষ করিছ আর আজ তুমি যদি এমুন কর তাহিলে মানষ্যেই বা কি বুলবে ? তুমিই বা সবার সামনে মুখ দেহাবে কেমুন করি আর আমি কিংবা তুমার ভাই? চলো, বাড়িত চলো, খায়ি-দায়ি কামে যাবা। মুন থাকি সব পাপ ফেলি দেও, চলো!” শমসেদের ক্রোধ সীমা ছাড়িয়ে যায়! ঝটিতে ছলেমাকে ছেড়ে দিয়ে বলে- ”আমাক কি তুমরা বেবাগ কলুর বলদ পায়িছো, যে তুমারেক কামায় করি করি খাওয়াবো সারাডা জীবন! আমার কুনো সাদ-আল্লাদ নাই? তুমরা তুমারির কথাডাই ভাবছো আর আমি..? বড় ভাই আছ তো কি হয়িছ আর ওই কি পারে তুমার সাথ? তুমি খালি খালি কেন ওর সাথ থাকপা? আমিতো মাঝি মধ্যেই শুনি তুমি অক বুলছো, গায়ে হাত দিয়োনা, সরি থাকো! কাল রাতেও তো তুমি বুলছিল্যা, না, জ্বালায়োনা! কেন খালি খালি চেষ্টা কর, পারনা আর আমার কষ্ট হয়, ঘুমাত পারিনা সারারাত। ছাড়ো, সর-ই ঘুমাও।” কথাগুলো শেষ হবার সাথে সাথেই যেন ছলেমার সত্বায় বাজ পড়ল! গভীর করে তাকিয়ে দেখে শমসেদের চোখে! সেখানে তাকিয়ে আরেকবার আঁতকে উঠে ভেতরে ভেতরে! ওর সমস্ত মুখে ফুটে উঠেছে ক্রোধান্বিত অভিব্যক্তি, যেখানে যুগপৎ মিশে আছে নিজের পৌরষিত গৌরবের তীর্যক চাহনী আর ভাইয়ের অক্ষমতার জন্য চরম ঘৃণা। ছলেমা যেন কুঁকড়ে গেল ভেতরে ভেতরে! আসলে দু’টো ঘর পাশাপাশি থাকলে, আর তা যদি হয় বেড়ার, তবে যে আরও সাবধান হতে হয় সেটা খেয়ালই ছিলনা। তাছাড়া ওকে নিয়ে সেরকম ভাবনা হয়ত ওর মনে আসেনি। যদিও একটা ক্ষুদ্র ঘটনা একবার মনে কিছুটা খটকার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল কিন্তু সেটাও পরে ভুলে গিয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল মাস ছয়েক আগে, যেটা আজ মনে পড়ে গেল।
সেদিন প্রচন্ড গরম পড়ায় দুপুর বেলা আরেকবার গোসল করে কাপড় ছাড়ছিল দরজা ভিড়িয়ে রেখে। হঠাৎ কি যেন মনে হওয়াতে বাইরে এসে দেখে দক্ষিণ পাশে বেড়ার কাছে চোখ মুখে চরম উত্তেজনা আর ঘামে জবজবে হয়ে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে শমসেদ। যদিও সে কামে গেলে দুপুরে খেতে আসেনা কারণ যার কামে যায় সেখানেই দুপুরে খেতে দেয়। তবে যেদিন যেদিন আধখোরাকির কাম থাকে সেদিন দুপুরে বাড়িতে খেতে আসে। শমসেদকে তখন ওভাবে দেখে কিছু একটা গভীর ভাবে ভাববার আগেই মনে হয়েছিল, ছেলেটা কাম থেকে এসেছে, নিশ্চয় খুব ক্ষুধা লেগেছে, তাই জলদি খেতে দিয়েছিল। ঘটনাটা আজ মনে পড়ে গেল। শমসেদ তাহলে ওকে অনেক আগে থেকেই নিজের মনের ভেতরে জায়গা করে দিয়ে রেখেছে। ছলেমা নিজে ভেবে কিছু বের করতে পারছিল না, কেবল বার বার করে ওর নিজের শরীরটাকেই মনে পড়তে লাগল! ও নিজেও তাজ্জব হয়ে যায় নিজের শরীরের এই রুপ দেখে! ভেবে কুল পায়না, এই অভাবী সংসারে শরীরের এই বাড়-বাড়নিত ভাব কি করে আসে ? তাছাড়া প্রতিরাতেই ওর স্বামী না পারলেও জোর করে বাধ্য করে মিলনে, যেখানে পা দুটো কেটে ফেলার পর থেকেই ওর যৌনশক্তি ক্ষয়ে গেছে অথচ সেই ক্ষয়িষ্ণু যত কিঞ্চিত বেঁচে থাকা যৌনক্ষুধাতেও প্রায় প্রতি রাতেই ওর শরীরে গমন করে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিসেতজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে পাশে। ছলেমার গত তিনটি বছর এভাবেই কেটেছে, রাতের পর রাত অতৃপ্তিত শরীরের জ্বালায় জেগে থেকেছে দুটো পা হীন, মাথা থেকে কোমর সর্বস্ব একতাল জড়ভরত মাংসের পাশে, যে ঘুমিয়ে থাকে সুখোকর ক্লানিতর প্রশানিততে! ছলেমা মাঝে মাঝে ভাবত আমার অতৃপ্তিত শারীরীক ক্ষুধায় কি আমার শরীরকে এভাবে ভর-ভরনত করে তুলছে ? কোথাও যেন কোন কমতি নেই যৌবনের !
আজকাল ছলেমার আর সহ্য হয়না প্রতিরাতের সেই অসহ্য যন্ত্রণা, যা রাতভর জেগে থেকে ওকে একা একা ভোগ করতে হয়। প্রথম দিকে তাও কিছু হলেও যৌনশক্তি অবশিষ্ট ছিল ওর স্বামীর, কিন্তু এখন সেটুকুও নেই, অথচ প্রতিরাতেই সেই আগের মতই অবস্থা, জোর করে মিলনে বাধ্য করে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে ছেড়ে দেয়া রাতভর। ছলেমা আর সহ্য করতে না পেরে গত কয়েকমাস ধরে আর সায় দেয়না আগের মত। ওর স্বামী জোর করলে ওই ঠেলে দুরে সরিয়ে দেয়, মাঝে মাঝে বিরক্তিতে শব্দ করে উঠে, যা কাল রাতেও করেছিল। নিশ্চয় শমসেদ এসব শুনেছে গত কয়েকমাস ধরে আর যা কখনও ভাবতে পারেনি তাও হয়ত ওর মনে বাসা বেঁধেছে। মানুষের গোপন প্রবৃত্তি গুলো খুব কাছ থেকে যখন জেগে ওঠার প্রত্যক্ষ উসকানি পায় তখন তাকে রোধ করা মানুষের সাধ্যর বাইরে চলে যায়। ছলেমা কিছুই বলতে পারলনা! শমসেদের পাশ থেকে উঠে চলে গেল বাড়ির দিকে। শমসেদ রাগে, ক্ষোভে একভাবে তাকিয়ে থাকল ছলেমার চলে যাবার দিকে আর কিছু একটা সংকল্প করে বসল মনের ভেতরে।
এরপর মাস তিনেক হয়ে গেছে কিন্তু এর মধ্যে শমসেদ কখনও ভুলেও আর তাকায়নি ছলেমার দিকে কিংবা কথা বলার চেষ্টা করেনি এতটুকু। ছলেমা নিজে বার বার আগ বাড়িয়ে কথা বলেছে, খেতে ডেকেছে, বাড়িয়ে দিয়েছে ভাতের থালি আর শমসেদ প্রতিবার-ই মাথা নিচু করে খেয়ে উঠে গেছে, একবারও চোখ তুলে তাকায়নি ওর দিকে। ছলেমার বুকে বিঁধেছে বার বার করে ওর এড়িয়ে যাওয়াটা। একটা গভীর অপমান বোধে ভেতরে ভেতরে সেও হয়ে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে ক্রোধান্বিত ওর প্রতি। যখন মানুষ স্বাভাবিক বিশ্বাসবোধে আকস্মিক বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন তার প্রবৃত্তিগুলো হয় সেভাবেই উজ্জীবিত, তা সে অনুরুপ পথে হোক কিংবা বিপরীত পথে। ছলেমারও হয়েছিল। মাঝে মাঝে ওর মনে হয়েছে, কি করে পারে শমসেদ তাকে এভাবে তুচ্ছ ভাবতে, এড়িয়ে যেতে ? যেখানে আজকাল গ্রামের যুবা থেকে বৃদ্ধ প্রায় সবাই ওর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, সামান্যতম কথা বলার জন্য থাকিয়ে মুখিয়ে, কেউ কেউ করে বসে খারাপ ইঙ্গিত মুখের উপরেই, সেখানে ও কি করে পারে এত সময় এক বাড়িতে এত কাছাকাছি থাকার পরও ওকে এভাবে এড়িয়ে যেতে? এমনকি একটিবার চোখ তুলে তাকায়ওনা ভুলে, অথচ এ সেই শমসেদ যে নিজেই সেদিন বাগানে ওকে শরীরে প্রচন্ডভাবে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমাক বাঁচাও, আমি পারছিনা আর, আমি তুমাক ছাড়া বাঁচপনা! আমাক বাঁচাও, না হলে মরি যাবো; তাহলে? ছলেমার ক্রোধ ও জিদ যেন ওকে গ্রাস করে নিচ্ছিল দিনকে দিন আর ও হয়ে উঠছিল অন্যরুপী ভেতরে ভেতরে ।
এর কয়েকদিন পরে এক সকালে হঠাৎ করে জমসেদের বুকে ভয়ানক ব্যাথা শুরু হয়। শমসেদ কামে গিয়ে খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে দেখে বাড়ি ভর্তি লোক জমে গেছে! ছলেমা ওর স্বামীকে নিয়ে কান্নাকাটি করছে! ব্যাথায় কোঁকাতে থাকা প্রায় নীল হয়ে আসা নিজের বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শমসেদ অনেকদিন পরে সার্বিক অর্থেই ভুলে গেল তার সব ক্রোধ, কামনা-বাসনা, বিপরীত মনোভাব। মুহূর্তেই নিজের সব দায়িত্ববোধ ফিরে পেয়ে মনের মধ্যে অনুভব করল একরাশ জমাট বাধা ব্যাথা ও সুতীব্র অনুশোচনা! ওর মন পড়ে গেল ওর শৈশবের সেই দিনগুলি, যখন তার ভাই তাকে দিনের পর দিন কষ্ট করে মানুষ করেছে। কোন আবদার অপূরণ রাখেনি কখনও। যখন যা চেয়েছে, তখন তাই দিয়েছে। মা-বাবা দু’জনার আদরেই তাকে বড় করে তুলেছে আর সে ভাই আজ চরম ব্যাথায় কাতরাচ্ছে অথচ ও কিছুই করতে পারছেনা। হঠাৎ কি মনে হতেই, শমসেদ ছুটে গিয়েছিল ভাইকে নিয়ে শহরের হাসপাতালে। দুটো দিন শহরের হাসপাতালে দৌড়াদুড়ি করতে করতে ভুলে গিয়েছিল নিজেকেসহ সবকিছু। দুদিন পরে কিছুটা আরাম হওয়াতে ডাক্তার বলেছিল- ”আরও দুটোদিন থাকলে বলতে পারব রোগীর অবস্থা, এখনও বলা যাচ্ছেনা কিছুই। তবে বেশ কিছু দামী ঔষধ লাগবে, আপনি কাল আমার সাথে একবার যোগাযোগ করুন।”
দুদিন আগে যখন ভাইকে নিয়ে ও শহরে আসে তখন নিজের কাছে যা টাকা ছিল তাই নিয়ে এসেছিল। এই দুদিনে দৌড়া-দুড়ি আর যাবতীয় ঔধষ-পত্র কিনতে কিনতে সব খরচ হয়ে গেছে। এখন আরও টাকা লাগলে তার গ্রামে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। প্রায় তিনমাস পরে সে ছলেমার কাছে গিয়ে বলল- ”ভাইয়ের ওষুধ কিনার লাগি আরও টেকা লাগবে, আমার কাছ তো আর টেকা নাই। আমি গ্রামে যাই, কাল সকালে টেকা লিয়ে আবার চলি আসপো।” ছলেমা সরাসরি তাকিয়েছিল ওর চোখের দিকে, যেনবা ঘৃণা, কিংবা অজানা ক্রোধ আর সেই সাথে ভর্ৎসনা। কেবল উত্তরে বলেছিল- ”এহানে আমাক রাখি যাছো, আমি কার কাছ থাকপো? আমি কি কুনোদিন এমুন করি থাকিছি?” ও তাকিয়েছিল ছলেমার মুখের দিকে নির্বাক অপরাধীর মত! শেষে ছোট করে বলেছিল,”তাইলে আমি করব?” ছলেমা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলেছিল- ”তুমিতো কাল সকালে আসপা, আমাক-ও লিয়ে চলো তুমার সাথ। বাড়ি-ঘরের কি অবস্থা জানিন্যা, পাড়াপাড়িতে কুনো কিছু ঠিক না করিই চলি আসিছি। তুমার সাথ গেলে সব ঠিক-ঠাক করি তুমার সাথ আমিও আবার সকালে চলি আসপো।” ও তাকিয়েছিল ছলেমার দিকে অথচ ছলেমার মুখ ছিল অন্য দিকে ফেরানো।
শেষে দুজনাই এসেছিল গ্রামে। ফেরার সময় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল আর আকাশটাও ছিল থম্*থমে হয়ে, যেনবা ঝড় তুলবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে। দুজনে পাশাপশি হাঁটতে হাঁটতে শমসেদএকবার খালি আসেত করে বলেছিল- ”ঘরডা এবির আর ছাওয়া যাবেন্যা, টেকা তো সব শেষ, ঝড়-টড় উঠলে না জান কি হয়?” ছলেমা উত্তর করেনি। রাতে খাওয়ার পর শুতে যাবে এমন সমসত দুনিয়া কাঁপিয়ে বেশ জোরে শুরু হল বাতাস, যা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের রুপ নিল! শমসেদ ভীষণ ভয় পেয়ে ভাবল, ঘর বাড়ি যেন সব উড়ে যাবে এখুনি! ও একবার ছলেমার কথা ভেবে বাইরে এসে দেখল, ছলেমা নির্বীকার ভাবে বসে আছে ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে, যেন ওর কোন হুশ নেই। ওর নিজের ভেতরেই চলছে কোন এক মহা প্রলংকারী ঝড়। শমসেদ কিছু বুঝতে পারলোনা, ক্রমশ একট অজানা আশংকায় ছলেমার কাছে যাবার আগেই ঝড়ের প্রকোপ আরও বেশি হল।
ও ছুটে বাইরে এসে ঘরের চারপাশ ঘুরে ঘুরে চাল-টাল ঠিক আছে কিনা দেখতে লাগল। দু’এক জাগায় নড়বড়ে দেখে তার দিয়ে শক্ত করে বেধে দিল। এরি মাঝে শুরু হয়ে গেল ঝম্*ঝমে বৃষ্টি। ও সবকিছু ঠিক ঠাক করে ভেজা শরীরে ঘরের মধ্যে এসে দেখে ছলেমা দাঁড়িয়ে! ওদিকে হাসপাতালে ওর বড় ভাইয়ের বুকের ব্যাথাটা আবারও হঠাৎ করে বেড়ে যায়। ঝড়ের রাতে বেডে পড়ে থেকে থেকে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ডাকছিল- ”ছলেমা! ছলেমা! শসসেদ! আমি পারছিনা, আমাক বাঁচা!” এই দুর্যোগময় রাতে ঝড় আর বৃষ্টির তান্ডবতা ভেদ করে সেই আর্তি কারও কাছে পৌঁছাচ্ছিল না! এদিকে ঘরে ঢুকতেই ছলেমা দৌড়ে এসে প্রচন্ডভাবে আঁকড়ে ধরল ওকে। ও বুঝতে পারার আগেই ছলেমা দু’হাতে প্রাণপণ আঁকড়ে ধরে ওর বুকের ভেতরে মুখ ঘষতে লাগল অনবরত! ওর মাথায় ঢুকছিলনা ও কি করবে ? কেমন জানি নিজেকে বোধ শূন্য পাচ্ছিল! নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু করার আগেই ঘরের ভেতের কাঁপতে থাকা বাতির হালকা আলোতে দেখল, ছলেমা এক এক করে সব কাপড় খুলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে নগ্ন! ঝড়ের প্রচন্ড তান্ডব আর প্রবল বৃষ্টিতে ওর মনে হচ্ছিল সব কিছু যেন ভেঙে-চুরে, ধুয়ে-মুছে নিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে। সব কিছু বিনাশ হযে যাবে, কেবল ও আর ছলেমা থাকবে তখনও এইভাবে, এই ঘরে। ও আসেত আসেত এগিয়ে গেল ছলেমার দিকে, ছলেমা গভীর আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে নিজেকে এলিয়ে দিল ওর শরীরে। প্রচন্ডভাবে কাঁপতে থাকা ছলেমাকে নিয়ে ও চলে গেল বিছানায়।
শমসেদ বিছানায় যখন ছলেমার শরীরে উপগত, তখন হাসপাতালের বেডে সীমাহীন যন্ত্রণায় সমস্ত ঝড়-বৃষ্টিকে বিদীর্ণ করে একটা চিৎকার একটানা ভেসে বেড়াচ্ছিল- ছলেমা! ছলেমা! শমসেদ! আর পারছিন্যা, আমাক বাঁচা! আর তখন ছলেমা ঘর্মাক্ত শমসেদের শরীরের নিচে রক্তের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্য ক্ষুধায় ভয়ানক ক্ষুধিত হয়ে ওর পিঠের বিভিন্ন অংশে নোখ বসিয়ে আমূল টানছিল আরও গভীরে, আরও ভেতরে! বাহ্যিক বোধহীন দুজনাই উন্মত্ত হয়ে ডুবেছিল সেই ভয়াল ক্ষুধায়! বেশ কিছুক্ষণ পর শমসেদ যখন ক্লানিততে এলিয়ে পড়ল ছলেমার পাশে, তখন হাসপাতালের বেডে একটা সাদা পোশাক পরিহিত হাত, আরেকটি নিথর ঠান্ডা হাত আলতো করে বিছানায় রেখে বলল-শেষ!
0 comments:
Post a Comment